শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৯ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার : মাস্টার্স পাস বা সমমানের ক্লাস ‘তাকমীল ফিল হাদিস’ (টাইটেল) সমাপ্তকারী গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে এক সমাবর্তন (দস্তারবন্দী) সম্মেলন সুনামগঞ্জে হওয়ায় শহরে দোলা লেগেছিল হাজারো প্রাণের। শহরের সাধারণ মানুষের কাছে এই সমাবর্তন ছিল এই প্রথম; তাও আবার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ক্বাওমী মাদরাসার। এ নিয়ে আয়োজকসহ দাতাগোষ্ঠী, সমর্থকদের মধ্যে ছিল উচ্ছ্বসিত মনোভাব; এই কাঙ্খিত দিনের জন্যই তারা অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিন ২২ ও ২৩ জানুয়ারি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ শুক্র ও শনিবার চলে এলো সবার সামনে। দুই দিনব্যাপি সমাবর্তনে বিশ্বের ইসলামি স্কলারগণ, বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অংশগ্রহণ করেন। যেই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে এই বিশাল আয়োজন, সেই ‘জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া সুনামগঞ্জ’-এর প্রিন্সিপাল শায়খ মাওলানা আব্দুল বছীর বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের আশা ও মেহনত আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছেন, বড় ধরণের কোন ঝামেলা ছাড়াই প্রশাসনের সহযোগিতায় সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে দুই দিনব্যাপি অনুষ্ঠানটি সমাপ্ত করতে পেরেছি; এজন্য মহান আল্লাহর দরবারে অসংখ্য কোটি শুকরিয়া জানাই। এটি সফল করতে বিভিন্নভাবে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, তাদেরকেও ধন্যবাদ জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন বাদ জুহর হতে রাত ১২টা পর্যন্ত চলা দুই দিনব্যাপি এই সমাবর্তন ৮টি অধিবেশনে ভাগ করা হয়। শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে প্রতিটি অধিবেশনেই আলাদা করে সভাপতি, উপস্থাপক, কোরআনে কারীম থেকে তিলাওয়াত, সংগীত পরিবেশন ও বক্তার তালিকা তৈরি করা হয়। অনুষ্ঠানের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে স্থানীয় প্রশাসনের লোক থাকলেও প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকগণও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অনুষ্ঠানস্থল ঘুরে দেখা গেছে প্রশাসনের লোকজন ঠিকই অবস্থান করছে, তবে কোন মানসিক চাপে নেই। কারণ, একটি ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই সমাবর্তন হওয়ায় এখানে আগত সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে কোন ধরণের নেতিবাচক চিন্তা যে নেই, তা দুই দিনের অনুষ্ঠান সমাপ্তির পরই বুঝা গেছে। সুতরাং স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনও মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারবেন না।
‘১৯৬৬ থেকে ২০১৬’ কেটে গেছে দীর্ঘ ৫০টি বছর; এ উপলক্ষ্যে ‘জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া সুনামগঞ্জ’ কর্তৃপক্ষ আয়োজন করেন ৫০ বছর পূর্তিতে দস্তারবন্দী বা সমাবর্তনের। জামেয়ার দক্ষিণের বিজিবির মাঠে নির্মিত হয় বিশাল প্যান্ডেল, এ প্যান্ডেলেই জমায়েত হন প্রাক্তন ছাত্র-শিক্ষক ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষের পদচারণায় ভরে ওঠে সুনামগঞ্জ শহর; দোলা দেয় নারী-পুরুষ ও আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মনে, এ যেন এক স্বর্গীয় সুখ ও সমাবেশ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন যথাক্রমে খলিফায়ে মাদানী শায়খুল হাদিস আল্লামা আব্দুল মুমিন শায়খে ইমামবাড়ি, জামেয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের মুহতামিম আল্লামা শায়খ যিয়াউদ্দিন, জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল (রহ) সিলেট-এর শায়খুল হাদিস আল্লামা মুহিবুল হক, হাফিজ মাওলানা মুহসিন আহমদ সাহেবজাদায়ে শায়খে কৌড়িয়া, দারুল হাদিস জাউয়াবাজার মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আব্দুস সোবহান, কামরূপদলং মাদরাসার মুহতামিম শায়খ মাওলানা আকবর আলী, সিলেটস্থ ভার্থখলা মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মউজদুদ্দীন, সৈয়দপুরের মাওলনা আব্দুন নূর, আমবাড়ি মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা সাজিদুর রহমান।
দুই দিনব্যাপি এই মহাসম্মেলনের উপস্থাপক হিসেবে ছিলেন শায়খুল হাদিস শায়খ মাওলানা সাজিদুর রহমান, মাওলানা জুনাইদ আহমদ কিয়ামপুরী, মাওলানা বদরুদ্দিন আল মাদানী, মাওলানা হারুনুর রশিদ, মাওলানা আবু সাঈদ, মাওলানা তৈয়্যিবুর রহমান চৌধুরী, মাওলানা দিলোয়ার হোসাইন, মাওলানা মিজানুর রহমান, মাওলানা আবুল কাসেম ও মাওলানা ত্বাহা হোসাইন।
‘জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া সুনামগঞ্জ’-এর ঐতিহাসিক দস্তারবন্দী মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আওলাদে রাসূল (সা), শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ)-এর সুযোগ্য সাহেবজাদা বিশ্ববরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা আসজাদ আল মাদানী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের মুহাদ্দিস মুফতি মোহাম্মদ ইউসুফ, খলিফায়ে মাদানী আল্লামা নোমান আহমদ, আন্তর্জাতিক মুফাসসিরে কোরআন শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী, আল্ল¬ামা জুনায়েদ আহমদ বাবুনগরী, সাবেকমন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, শায়খুল হাদিস আল্লামা শিহাব উদ্দিন, দরগাহপুর মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস আল্লামা নূরুল ইসলাম খান, মুফতি ফুরকানুল্লাহ খলিল, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, আল্লামা আব্দুর রব ইউসূফি, আল্লামা আব্দুশ শহিদ, মাওলানা ফজলুর রহমান বানিয়াচঙ্গী, মুফতি মাওলানা আবুল কালাম জাকারিয়া, শায়খুল হাদিস আল্লামা ফজলুর রহমান খান, মাওলানা শাহ নজরুল ইসলাম, মাওলানা শুয়াইব আহমদ, মাওলানা হোসাইন আহমদ নোমানী, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম, মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, হাফেজ মাওলানা তাফহিমুল হক, মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দীন ইকরাম প্রমুখ। সম্মেলনে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী আবুল কালাম, ফরিদ আহমদ পাঠান প্রমুখ।
পবিত্র কালামে পাক থেকে তিলাওয়াত করেন আন্তর্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত হাফিজ জাকারিয়া আহমদ, হাফিজ ইয়ামিন হোসাইন, হাফিজ জুবায়ের আহমদ, হাফিজ মশিউর রহমান, হাফিজ লোকমান আহমদ, হাফিজ সোলাইমান আহমদ। সংগীত পরিবেশন করেন লণ্ডন থেকে আগত এহসান তাহমিদ ও জাগরণ ইসলামি দলের শিল্পীবৃন্দ। দস্তারবন্দী মহাসম্মেলনের প্রথমদিন শুক্রবার জুমআর নামাযে খুতবা পাঠ ও ইমামতি করেন ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের মুহাদ্দিস মুফতি মোহাম্মদ ইউসুফ। মহাসম্মেলন উপলক্ষ্যে একটি বিশেষ প্রতিবেদন পেশ করেন জামেয়ার প্রিন্সিপাল ও দস্তারবন্দী মহাসম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক শায়খ মাওলানা আব্দুল বছীর। জামেয়া থেকে তাকমীল ফিল হাদিস (টাইটেল) সমাপ্তকারী প্রায় শতাধিক আলেমকে ‘দস্তারে ফযিলত’ বা সমাবর্তন পাগড়ি পড়িয়ে দেন শীর্ষস্থানীয় উলামা-মাশায়েখগণ।
আওলাদে রাসূল (সা), শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ)-এর সুযোগ্য সাহেবজাদা বিশ্ববরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা আসজাদ আল মাদানী প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, ক্বাওমী মাদরাসাগুলো হলো দ্বীনের ঘাঁটি, অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় ভূমিকা পালন করছে তারা। যতদিন এসব মাদরাসা ও মাকাতিবগুলো অক্ষত থাকবে; ততদিন ইসলাম জীবিত থাকবে। তাই জীবনের সকল ত্যাগ-তিতিক্ষা বিসর্জন দিয়ে হলেও ক্বাওমী মাদরাসা গুলোকে ঠিকিয়ে রাখতে হবে। উল্লেখ্য, জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া সুনামগঞ্জ-এর সমাবর্তন উপলক্ষ্যে সমসাময়িক বিষয়সহ একটি দৃষ্টিনন্দন ‘স্মারক’ প্রকাশ করা হয়েছে।